ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে হৃদয়ের সম্পর্ক গুলি ধীরে ধীরে ফিকে যায় আর এরপর ঘুনে ধরা শুকনো গাছের মত ধীরে ধীরে মাটির সঙ্গে মিশে যায়।।
ব্যস্ততার অজুহাত গল্পঃ- “ব্যস্ততা, নাকি দূরত্ব!”
ছোট্ট ঈশান চিরকাল ধরে দেখে এসেছে তার মা আর বাবা দুজনেই নিজেদের কাজে খুব ব্যস্ত আছে। মা, বাবা দুজনের কেউই ঈশান কে সময় দেওয়া তো দূরের কথা, ঈশানের দিকে তাকিয়ে দেখেছে কিনা সন্দেহ আছে।
মা আর বাবা দুজনেই অফিসের কাজে, নয়তো ফোনে ব্যস্ত।
ছোট থেকে এইসব দেখেই বড় হয়েছে ঈশান।
আজ সে তার কয়েকজন বন্ধুদের সাথে পিকনিকে আড্ডা দিচ্ছে। কিন্তু এ কি! সবাই সবুজ মাঠ না দেখে যে যার নিজেদের মতো ফোনের মধ্যে ডুবে আছে। কারোর সাথে যেন কারোর সম্পর্ক নেই। সবাই পাশাপাশি বসে থাকলেও, একে অপরের দিকে তাকানোর সময়টুকু যেন কারোর মধ্যে নেই।
ঈশান একলা দূরে দাঁড়িয়ে দেখে সব। সে এগিয়ে গিয়ে একজন বন্ধু কে বলে, “কি রে, ফোনে কি দেখছিস শুনি?”
-“একটু ব্যস্ত আছি ভাই।”
-“হুম তা তো জানি। কিন্তু মাঝে মাঝে এই ফোনের জগতে ব্যস্ত না থেকে তো কল্পনার বেখেয়াল জগতেও ব্যস্ত হতে পারিস!”
-“আরে ডিজিটাল যুগে ওসব চলে না ভাই!”
শুকনো হেসে চলে যায় ঈশান। কাকে বলবে, সবাই-ই তো তাই… ব্যস্ত। পাশাপাশি বসেও সবাই একে অপরের থেকে আলোকবর্ষ এর মতো দূরে।
ঐ যে সেই গানটা-
“ভেবে দেখেছ কি তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে তারও দূরে,
তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে “
সত্যিই তাই।
পিকনিক টা জোর করে পিকনিক না বললে ঈশান বুঝতোই না এটা যে পিকনিক ছিল। পিকনিক কোনোরকম শেষ হয়ে সবাই বাড়ি ফেরার তোড়জোড় করতে লাগল। একটা সময় পর সবাই বাড়ি ফিরে গেল। ফানুসের মতো অনুভূতি হচ্ছে ঈশানের এই পিকনিক নিয়ে।
বাড়ি ফিরেও সেই একই দৃশ্য। বাবা ল্যাপটপ-এ ব্যস্ত আর মা ফোনে। ছেলের আসায় সামান্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে আবার যে যার ভাবনায় মগ্ন হলো।
ঈশান নিষ্ফল দৃষ্টি তে তাদের দিকে চেয়ে ঘরে চলে যায়।
মনে মনে ভাবে, একবারও জানতে চাইলে না আজ পিকনিক কেমন হল! অবশ্য জানতে চাইবেই বা কেন, তোমরা যে ব্যস্ত।
পড়ুনঃ- জীবন সংক্রান্ত ৪৯ টি উপদেশ
রাত গড়িয়ে খাবার সময় এলে ঈশান জানিয়ে দেয় সে রাতে আর খাবে না। এই বলে শুয়ে পড়ে সে।
শুয়ে শুয়ে জানলার বাইরের দেখা ফাটা ফাটা মেঘের আকাশের দিকে চেয়ে বলে, আজ সবাই এত ব্যস্ত কেন? শারীরিক ভাবে সবাই পাশাপাশি আছি, ছবির অ্যালবামে কাঁধে কাঁধ রেখে আছি, নানারকম সামাজিক স্বীকৃতি তে নামাঙ্কিত সম্পর্ক গুলো টিকে আছে কিন্তু মানসিক ভাবে?
নাহ, মানসিকভাবে সবাই সবার থেকে বহুদূরে। এতোটাই দূরে যে সহজে ফিরে আসা সম্ভব নয়। ব্যস্ততা নাকি দূরত্ব তা বুঝে উঠতে পারে না ঈশান। সবাই যেন রক্ত মাংসের মানুষ বাইরে থেকে, অন্তরটা পুরো যন্ত্র।
আত্মীয়র বাড়িতে আর হয়না সকলে মিলে একসাথে আড্ডা দিয়ে হৈ-হল্লা করা। সে জায়গায় সবাই নিজেদের মুঠো ফোনে বন্দি ।
মাঠে আর বৃষ্টিতে ফুটবলে লাথি দেওয়া হয় না উপরন্তু সবাই পাশাপাশি বসেই দূরত্ব বজায় রেখে ভিডিও গেমে মত্ত।
কফিহাউস বা লাইটহাউসের আলো আজ ম্লান, সবার অস্বাভাবিক ও ক্রমবর্ধমান ব্যস্ততায়।
সবাই এত ব্যস্ত কেন? ঈশান মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করে।
এত প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে , এত দৌড়াতে গিয়ে মানুষ হাঁফিয়ে ওঠে না কখনো?
হাঁফিয়ে উঠলে কি করে শুনি! ঈশান ব্যর্থ হাসি হাসে আপন মনে। যাই হোক, পরদিন স্কুল যাওয়া।
প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যন্ত্রের মতো রুটিন মাফিক জীবন। সকালে সব কাজ সেরে বাবা-মা বেরোয় অফিসে আর ঈশান ওর স্কুলে।
কারোর মনে পিকনিক নিয়ে কোনো অনুভুতি দেখল না ঈশান।
কি হারিয়ে যায় নি, সবটাই হারিয়ে গেছে। সেই নির্মল ছোটবেলা যখন সত্যি সত্যি ছেলেমেয়েরা একসাথে কাদামাটি মেখে খেলা করত। আজকের ছোটবেলাতেও কৃত্রিমতার ছাপ। ভিডিও গেমে আনন্দ খুঁজে পায়। আর এই সময়ের সাথে সাথে এই ক্রমবর্ধমান বিবর্তনের কারণে ছোটবেলা থেকেই ছেলেমেয়েদের এই একসাথে খেলাধুলা বা মেশা টা “ছোটবেলাকার প্রেম” হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে। হায় ভেবে নেওয়ার কি ছিরি!
পড়ুনঃ- স্বামী বিবেকানন্দ ও চানক্য উক্তি
ঈশান ভাবে, আমরা সবাই কত বড় হয়ে গেলাম! ‘”১ টাকায় ৫ টা চকলেট’ পাওয়া থেকে ‘৫ টাকায় ১ টা চকলেট পাওয়ার মাঝের সময়টুকুতে আমরা বড়ো হয়ে গেলাম! বন্ধুদের “নিচে আয়” থেকে “অনলাইন আয়” বলার মাঝের সময়টুকুতে আমরা বড়ো হয়ে গেলাম!
‘মা আর ৫ মিনিট ঘুমাতে দাও’ বলা থেকে নিজের হাতে অ্যালার্ম বন্ধ করার মাঝের সময়টুকুতে আমরা বড়ো হয়ে গেলাম! “খেলনা ভেঙে যাওয়ার কষ্টে কেঁদে বুক ভাসিয়ে দেওয়া থেকে মন ভেঙে চুরমার হওয়ার মাঝের সময়টুকুতে আমরা বড়ো হয়ে গেলাম! ” চল আগে দেখা করি তারপর প্ল্যান করি” বলা থেকে ‘আগে প্ল্যান করি তারপর দেখা করব’ বলার মাঝের সময়টুকুতে আমরা বড়ো হয়ে গেলাম! “আমি বড়ো হতে চাই’ বলতে বলতে ‘আমি শৈশবে ফিরে যেতে চাই সময়টুকুতে আমরা বড়ো হয়ে গেলাম।
সবাই অনেক বড় হয়ে গেছে , সবাই অনেক ব্যস্ত হয়ে গেছে, অগোছালো হওয়ার সময় কোথায় শুনি!
ঈশান দিনদিন আরো অনেক বেশি একাকীত্ব অনুভব করছে। সারাদিন এই ইঁদুর দৌড়ের মাঝে প্রতিযোগী হিসেবে দৌড়তে দৌড়তে যখন ক্লান্ত হয়ে ফিরছে নিজের পৃথিবীতে, তখন মনে হচ্ছে একটা কথাই, এটা ব্যস্ততা নাকি একে অপরের থেকে আলোকবর্ষ দূরত্ব?
পরদিন স্কুলে ক্লাস চলছে। স্কুল থেকে ফেরার পথে সে খেয়াল করে বেশ কয়েকজন গার্জেন নিজেদের ছেলেমেয়েদের বোঝাচ্ছে তারা যেন বাকিদের সাথে না মেশে, বেশি কথা না বলে। এ কি-রকম আশ্চর্য মানসিকতা! ভাবে ঈশান।
ঈশান ওদের দিকে তাকিয়ে ভাবছে এসব কথা, হঠাৎ ওর পাশে আরেকটা ছেলে এসে দাঁড়িয়ে বলে, ভাই, সবটা অনেক বদলে গেছে। এখন মানুষ এতোই ব্যস্ত যে রাস্তায় কোনো অসহায়, মৃতপ্রায় ব্যক্তি কে সেবা করার জন্য না ছুটে তার সাথে ছবি তোলে। এখন মানুষ এতোই ব্যস্ত, যে একটা ঘরে সব কাছের আত্মীয়দের সাথে একসাথে বসে থাকলেও, সবাই নিজেরা নিজেদের মুঠো ফোনে বন্দি থেকে ছবি পোস্ট করে লেখে, “enjoyable moment with family!” এখন মানুষ এতোই ব্যস্ত যে মাঠে পায়ে লাথি মেরে ফুটবল না খেলে, গেমের স্ক্রিনে টানটান মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করে। ভাই এগুলো ব্যস্ততা নয় রে, এগুলো দূরত্ব।
পাশাপাশি সব দেহ গুলো বসে থাকলেও, আদতে আত্মা টা নিজের মধ্যে আটকে রয়েছে। যার সাথে যোগাযোগ নেই এই পৃথিবীর কোনো প্রান্তের, কোনো কিছুর সাথে, কারোর সাথে।
ঈশান অবাক হয় ওর মতো করে কেউ ভাবে দেখে। ও তাই বলে, “তুমি কে, তোমার নাম কি?”
“আমি অভ্র, একটা বাউণ্ডুলে ছেলে। কোনো কাজ কাম নেই, পড়াশোনা নেই, ব্যস্ততা নেই, থাকি আপন খেয়ালে।”
পড়ুনঃ- সেরা তিনটি নৈতিক শিক্ষা মূলক গল্প
“অভ্র, আমার বন্ধু হবে তুমি?”
“নিশ্চয়ই। তোমার নাম কি?”
-“আমার নাম ঈশান।”
-“ঠিক আছে আজ থেকে তুমি আর আমি একে অপরের বন্ধু।”
-হ্যাঁ।
দুইজনেই খুব খুশি।
ঈশান বলে, “জানো অভ্র, আমার কথা শোনার মতো বা আমার সাথে সময় কাটানোর মতো কেউ নেই। মাও চাকরি করে আর বাবাও চাকরি করে, দুজনেই ব্যস্ত। আমি স্কুলে থাকাতে ভেবেছিলাম বন্ধুদের মাঝে নিজেকে একটু খুঁজে পাবো, কিন্তু না, সেখানেও সবাই নিজেদের মতো ব্যস্ত । আমি পুরো একা হয়ে গেছি। আমি ব্যস্ত হতে পারি না গো, কেন জানি না এই ব্যস্ততা কে আমার অহেতুক দূরত্ব মনে হয় একে অপরের থেকে। তুমি কিছু বলো অভ্র।” দুই বন্ধু স্কুল থেকে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলে।
অভ্র বলে, “তুমি ঠিকই বলেছো ঈশান। আসলে কি জানো, মানুষের মন, অনুভূতি, কল্পনা, আবেগ সবটাই আজ যন্ত্রের মতো। রক্ত মাংসের মানুষ বাইরে থেকে দেখতে লাগলেও আসলে অনুভূতি হীন যন্ত্রমানব সব। তাই আপনজনের প্রতি টান নেই, ফিরে তাকানো নেই। তৈরি করা নেই কোনো সুন্দর মুহূর্ত যেটা কোনো একসময় মনে পড়লে আপনমনেই হাসির ঝিলিক দিয়ে নস্টালজিক মনে হবে। সব হারিয়ে গেছে ঈশান।
এখন তোমার বা আমার মতো কিছু মানুষ জল ছাড়া মাছের মতো ছটফট করে একটু সময় পাবার আশায়, যেখানে মনের সমস্ত কথা মন খুলে বলা যায়, নীল আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে দুই হাত মেলে চিৎকার করে বলা যায়, অনেক তো কাজ হলো, অনেক ব্যস্ত থাকা হল, এবার না হয় ব্যস্তহীন সেই কাছের মানুষ গুলোর সাথে একটু কাছের করে সময় কাটানো যাক। অনেকদিন যে একসাথে হাসা হয়নি অকারণে। হাসতে গেলেও মেপে হাসতে হয় কারণ সবাই যে ভয়ানক ব্যস্ত। কারোর দিকে তাকিয়ে দেখার সময় নেই, ভাবার সময় নেই অত। দুনিয়া দুনিয়ার মতো ছুটছে আর তোমার আমার মতো মানুষ পারছে না এই প্রতিযোগিতা তে ছুটতে বরং আমরাই একদিন আস্তে আস্তে হারিয়ে যাবো এই ব্যস্ততার ভীড়ে ব্যস্ত মানুষের পায়ের চাপে।
তাতেও হয়ত কারোর ব্যস্ত শেষ হবে না।
-“না অভ্র, তুমি ভুল বললে একটু, একটা সময় পর থামবে এই প্রতিযোগিতা, থামবে এই নিজ স্বার্থে করা অহেতুক ছোটাছুটি , শেষ হবে এই অহেতুক ব্যস্ততা । তখন যান্ত্রিকতায় আবদ্ধ মনটাও ছটফট করবে সমস্ত আবেগ, অনুভূতি গুলো প্রকাশ করতে। দিন শুরুতে ব্যস্ত আর দিনশেষে ক্লান্ত মনটা খুঁজবে তখন তার মতোই ব্যস্ত সব কাছের মানুষদের কে, এই আশায়, হয়তো এবার সবার ব্যস্ততা শেষ হয়েছে, শেষ হয়েছে দূরত্ব। এবার হয়ত সত্যিই কাছাকাছি আসা যাবে, বলা যাবে মনের সবটা। বিবর্ণ মনটা রঙিন হতে চাইবে কোনো একটা সময়তেই, তখন নিজের মনকে দিনশেষে নিজেই জিজ্ঞাসা করবে, এতদিন ধরে যা করলাম তা কি ব্যস্ততা নাকি দূরত্ব?”
মুক্ত বিহঙ্গের ভাবনায়-
সমস্ত কপিরাইট ছাড়পত্র দ্বারা সংরক্ষিত। গল্পটির ভিডিও বা অডিও বা অন্য কোনো মাধ্যমে অন্যত্র প্রকাশ আইন বিরুদ্ধ। ছাড়পত্র এর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণে বাধ্য হবে।
গল্প পাঠাতে পারেন- charpatrablog@gmail.com -এ অথবা সরাসরি WhatsApp -এর মাধ্যমে এখানে ক্লিক করে।
পড়ুনঃ- সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে শিক্ষণীয় গল্প ছাত্রদের জন্য প্রেরণা মূলক গল্প
সোশ্যাল মিডিয়ায় ছাড়পত্রঃ-
ফেসবুক Group - গল্প Junction
ফেসবুক- ছাড়পত্র
টেলিগ্রাম- charpatraOfficial
WhatsApp Group- ছাড়পত্র (২)
ব্যস্ততার অজুহাত গল্প। জীবন নিয়ে গল্প। 1 new bengali story on life
from ছাড়পত্র https://ift.tt/eiBj3vR
via IFTTT
0 Comments